Skip to main content

'অভিশাপ' ---কাজী নজরুল ইসলাম

*
        যেদিন আমি হারিয়ে যাব, 
        বুঝবে সেদিন বুঝবে,
        অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় 
        আমার খবর পুছবে-
        
        বুঝবে সেদিন বুঝবে!


        ছবি আমার বুকে বেঁধে
        পাগল হ’লে কেঁদে কেঁদে
        ফিরবে মর” কানন গিরি,
        সাগর আকাশ বাতাস চিরি’
        যেদিন আমায় খুঁজবে-

        বুঝবে সেদিন বুঝবে!


        স্বপন ভেঙে নিশুত্ রাতে 
        জাগবে হঠাৎ চমকে,
        কাহার যেন চেনা-ছোঁওয়ায় 
        উঠবে ও-বুকে ছমকে,-

        জাগবে হঠাৎ চমকে!


        ভাববে বুঝি আমিই এসে
        ব’সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,
        ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
        শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
        বেদনাতে চোখ বুঁজবে-
        বুঝবে সেদিন বুঝবে!

        গাইতে ব’সে কন্ঠ ছিঁড়ে 
        আসবে যখন কান্না,
        ব’লবে সবাই-“ সেই যে পথিক 
        তার শেখানো গান না?’’

        আসবে ভেঙে কান্না!


        প’ড়বে মনে আমার সোহাগ,
        কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!
        প’ড়বে মনে অনেক ফাঁকি
        অশ্র”-হারা কঠিন আঁখি
        ঘন ঘন মুছবে-
        বুঝবে সেদিন বুঝবে!

        আবার যেদিন শিউলি ফুটে 
        ভ’রবে তোমার অঙ্গন,
        তুলতে সে ফুল গাঁথতে মালা 
        কাঁপবে তোমার কঙ্কণ-

        কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!


        শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
        প’ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি’!
        বুকের মালা ক’রবে জ্বালা
        চোখের জলে সেদিন বালা
        মুখের হাসি ঘুচবে-
        বুঝবে সেদিন বুঝবে!

        আসবে আবার আশিন-হাওয়া, 
        শিশির-ছেঁচা রাত্রি,
        থাকবে সবাই - থাকবে না এই 
        মরণ-পথের যাত্রী!

        আসবে শিশির-রাত্রি!


        থাকবে পাশে বন্ধু স্বজন,
        থাকবে রাতে বাহুর বাঁধন,
        বঁধুর বুকের পরশনে
        আমার পরশ আনবে মনে-
        বিষিয়ে ও-বুক উঠবে-
        বুঝবে সেদিন বুঝবে!

        আসবে আবার শীতের রাতি, 
        আসবে না'ক আর সে-
        তোমার সুখে প’ড়ত বাধা 
        থাকলে যে-জন পার্শ্বে,

        আসবে না'ক আর সে!

        
        প’ড়বে মনে, মোর বাহুতে
        মাথা থুয়ে যে-দিন শুতে,
        মুখ ফিরিয়ে থাকতে ঘৃণায়!
        সেই স্মৃতি তো ঐ বিছানায়
        কাঁটা হ’য়ে ফুটবে-
        বুঝবে সেদিন বুঝবে!


        আবার গাঙে আসবে জোয়ার, 
        দুলবে তরী রঙ্গে,
        সেই তরীতে হয়ত কেহ 
        থাকবে তোমার সঙ্গে-
        দুলবে তরী রঙ্গে,

        প’ড়বে মনে সে কোন্ রাতে
        এক তরীতে ছিলেম সাথে,
        এমনি গাঙ ছিল জোয়ার,
        নদীর দু’ধার এমনি আঁধার
        তেমনি তরী ছুটবে-
        বুঝবে সেদিন বুঝবে!


        তোমার সখার আসবে যেদিন 
        এমনি কারা-বন্ধ,
        আমার মতন কেঁদে কেঁদে 
        হয়ত হবে অন্ধ-
        সখার কারা-বন্ধ!


        বন্ধু তোমার হানবে হেলা
        ভাঙবে তোমার সুখের মেলা;
        দীর্ঘ বেলা কাটবে না আর,
        বইতে প্রাণের শান- এ ভার
        মরণ-সনে বুঝ্বে-
        বুঝবে সেদিন বুঝবে!


        ফুটবে আবার দোলন চাঁপা 
        চৈতী-রাতের চাঁদনী,
        আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় 
        বাজবে আমার কাঁদনী-
        চৈতী-রাতের চাঁদনী।


        ঋতুর পরে ফিরবে ঋতু,
        সেদিন-হে মোর সোহাগ-ভীতু!
        চাইবে কেঁদে নীল নভো গা’য়,
        আমার মতন চোখ ভ’রে চায়
        যে-তারা তা’য় খুঁজবে-
        বুঝবে সেদিন বুঝবে!


        আসবে ঝড়, নাচবে তুফান, 
        টুটবে সকল বন্ধন,
        কাঁপবে কুটীর সেদিন ত্রাসে, 
        জাগবে বুকে ক্রন্দন-
        টুটবে যবে বন্ধন!


        পড়বে মনে, নেই সে সাথে
        বাঁধবে বুকে দুঃখ-রাতে-
        আপনি গালে যাচবে চুমা,
        চাইবে আদর, মাগবে ছোঁওয়া,
        আপনি যেচে চুমবে-
        বুঝবে সেদিন বুঝবে।


        আমার বুকের যে কাঁটা-ঘা 
        তোমায় ব্যথা হানত্
        সেই আঘাতই যাচবে আবার 
        হয়ত হ’য়ে শ্রান্ত–
        আসবে তখন পান্থ...

        হয়ত তখন আমার কোলে
        সোহাগ-লোভে প’ড়বে ঢ’লে,
        আপনি সেদিন সেধে কেঁদে
        চাপবে বুকে বাহু বেঁধে,
        চরণ চুমে পূজবে-

        বুঝবে সেদিন বুঝবে!
       




(কাজী নজরুল ইসলাম)